
রাত্রি' — এলি উইজেলের কলমে এক নির্লজ্জ অন্ধকারের মানবিক দলিল।'রাত্রি' — এলি উইজেলের কলমে এক নির্লজ্জ অন্ধকারের মানবিক দলিল। ‘রাত্রি’ (Night) হল বিশ্বখ্যাত নোবেলজয়ী ইহুদি লেখক ও হলোকাস্ট-সারভাইভার এলি উইজেলের আত্মজৈবনিক স্মৃতিচারণা। এই ছোট অথচ প্রভাবশালী বইটি এক তরুণ ছেলের চোখ দিয়ে নাৎসি জার্মানির মৃত্যুক্যাম্পগুলির বিভীষিকাময় বাস্তবতাকে তুলে ধরে। এটি কেবল ইতিহাসের একটি অধ্যায় নয়—এটি মানবতার অন্তর্গত অন্ধকারকে গভীরভাবে অনুভব করার একটি অমূল্য সুযোগ। বইটি শুরু হয় এলিজার নামক এক কিশোরের জীবন দিয়ে, যে হাঙ্গেরির একটি ছোট শহর থেকে পরিবারসহ তুলে আনা হয় অসউইৎস ও পরে বুকেনওয়াল্ডে। পাঠক ধাপে ধাপে দেখে, কীভাবে এক কোমলমতি ছেলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়—তার ঈশ্বরে বিশ্বাস, পারিবারিক বন্ধন এবং সর্বোপরি তার মানবতা—সবকিছু একটি একটি করে বিলীন হয়ে যায়। উইজেলের ভাষায়, গ্যাস চেম্বারের ধোঁয়ার মাঝে ঈশ্বর নীরব হয়ে যান। বইটিতে ঈমানের বিপর্যয় এক বড় থিম, যেখানে তিনি বলেন— সেই রাতে, প্রথমবারের মতো, আমি ঈশ্বরের পরিবর্তে মানুষকে অভিশাপ দিয়েছিলাম। একদিকে বাবার প্রতি দায়িত্ব, অন্যদিকে বেঁচে থাকার তীব্র আকাঙ্ক্ষা—এই দ্বন্দ্বও পাঠকের মনে গভীর দাগ কাটে। অনেক সময় দেখা যায়, মৃত্যু বা খাবারের লোভে ছেলে তার বাবাকে ত্যাগ করছে—মানুষ তখন আর মানুষ থাকে না, হয়ে ওঠে শুধুই এক জীবিত দেহ। এলি উইজেলের লেখনী সরল অথচ গভীর। অলংকারে ভরপুর নয়, বরং কাঁচা বাস্তবতায় পরিপূর্ণ। প্রতিটি বাক্যে রয়েছে এক অনুচ্চারিত আর্তনাদ, প্রতিটি ছত্র যেন জীবনের আর্তচিৎকার। এ এক আত্মদর্শনের দলিল—যেখানে শব্দের থেকে নিঃশব্দটাই অধিক অর্থবহ। ‘রাত্রি’ কেবল ইহুদি নিধনের এক আত্মজৈবনিক দলিল নয়, এটি ইতিহাসের কাছে এক প্রামাণ্য সাক্ষ্য। যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে এ বই আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয়—মানবতা কতটা ভঙ্গুর, আর মানুষ কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। বাংলায় অনুদিত এই বইটি বাঙালি পাঠকের কাছে ইতিমধ্যেই সমাদৃত। রাত্রি’ একটি কাহিনি নয়, এক জীবন্ত স্মৃতি।